বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: রাজনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে
মানুষের ইতিহাসের সুদূর অতীতে যাযাবর বৃত্তির কথা তোমরা জেনেছ। নিরাপদ জীবন এবং খাদ্যের সংস্থানে মানুষ এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাতায়াত করত। এই প্রক্রিয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া এবং বাংলা অঞ্চলের তৈরি হয়েছিল এক গভীর সংযোগ। বিশ্বের নানান অংশ থেকে বিভিন্ন যোদ্ধাদল, শাসক, বণিকগোষ্ঠী ভারতবর্ষ এবং ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তের দিকে এসেছে, সম্পদ ও ক্ষমতা দখল করেছে, শাসন ও শোষণ করেছে, অনেকেই বসতি স্থাপন করেছে এবং ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি নির্মাণ ও বিনির্মাণে ভূমিকা রেখেছে।
শাসকশ্রেণির নির্ধারণ করে দেওয়া রাজস্ব প্রদান করে, বিধিবিধান মেনে নিয়েই মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে গেছেন। তবে মানুষ যে সব সময়ই বিনা বাক্য ব্যয়ে শাসকদের সকল আদেশ মেনে গৎবাঁধা জীবনযাপন করেছে তা কিছুতেই বলা যাবে না। বিভিন্ন সময়েই দেখা যায়, অত্যাচারী শাসককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবার জন্য মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, বিপ্লব ও বিদ্রোহ করেছে। এসবের মধ্য দিয়েই মানুষ ক্রমে ক্রমে নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
রাষ্ট্র ও রাজতন্ত্রের গোঁড়ার কথা
পৃথিবীতে প্রথম কবে রাজা ও রাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল? বিভিন্ন গবেষণার আলোকে ইতিহাসের পণ্ডিতগণ বলে থাকেন যে, আজ থেকে প্রায় সাত-আট হাজার বছর আগেই মানুষ যখন নগর সভ্যতা গড়ে তুলতে শুরু করে, তখনই রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনৈতিক সংগঠন এবং রাজতন্ত্রের সূচনা হয়। এই রাষ্ট্র বা রাজ্যব্যবস্থার উদ্ভবের পেছনেও কৃষির ভূমিকা ছিল ব্যাপক। আদি যুগের শিকার ও সংগ্রহজীবী মানুষ যখন স্থায়ী বসতি স্থাপন করে কৃষিকাজ শুরু করে তখন তাদের জীবনব্যবস্থা বদলে যায়। কৃষি জমির চাহিদা বেড়ে যায়। জমির উপর ব্যক্তির মালিকানা প্রতিষ্ঠা এবং তা রক্ষা করার প্রয়োজন হয়। কৃষি থেকে প্রচুর পরিমাণে সম্পদ উৎপাদিত হতে থাকে। শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে। মানুষ যখন বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে শিকার ও সংগ্রহ করে বেড়াতো তখন একেকটি গোত্রে একেকজন গোত্রপতি থাকত। কিন্তু স্থায়ী বসতি স্থাপনের পর গোত্র প্রথার পরিবর্তে বৃহৎ সমাজ গড়ে ওঠে। নানান শ্রেণি পেশার মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই মানুষদের নিরাপত্তা, বাইরের আক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষা, আইন-কানুন তৈরি ও তা বাস্তবায়নের দরকার হয়। আর এভাবেই একটি শক্ত কাঠামো গড়ে ওঠে। গোত্রপতি বা দলপতিদের মধ্য থেকেই কেউ একজন আরও বেশি শক্তি অর্জন করে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করে রাজার আসনে আসীন হন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন ধর্মগুরুরাও। রাজা এবং ধর্মগুরুরা মিলে নগরগুলোতে একটি শক্তিশালী রাজতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করেন। ধীরে ধীরে তাঁরা অনেক বেশি শক্তি ও সম্পদ সঞ্চয় করেন। নিজেদের জন্য সুরক্ষিত দুর্গের ভেতর উন্নত বাসস্থান নির্মাণ করেন। সশস্ত্র প্রহরী দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। এভাবে সমাজে অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ থেকে রাজা ও ধর্মগুরুরা নিজেদের আলাদা করে ফেলেন। নগরের সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, বণিক ও কৃষকদের নিরাপত্তা দেবার নাম করে কর বা খাজনা আদায় করেন। বিপুল অর্থের মালিকানা লাভ করেন। শুধু তা-ই নয়, একজন শাসক বা রাজার মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানই যেন রাজা হয়, সেই ব্যবস্থাও তাঁরা করে যান। এভাবেই রাজা ও রাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়।
প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া, হরপ্পা, গ্রিক-রোমান সভ্যতাগুলোর বিকাশের সঙ্গে এই রাজতন্ত্রের বিকাশের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। রাজ্য ও রাজতন্ত্রের আদি রূপ দেখা যায় এই সভ্যতাগুলোতেই। রাজা ছিলেন একজন যোদ্ধা ও যোদ্ধাদের প্রধান। তার জীবন ছিল অসীম সম্পদ আর ক্ষমতায় পূর্ণ। রাজার সহযোগী ধর্মগুরু, উপদেষ্টা এবং সেনাপতিরাও ছিলেন সেই ক্ষমতার অংশ। তারা ছিলেন অভিজাত শ্রেণির অন্তর্গত। রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধির আরও একটি প্রধান উপায় ছিল যুদ্ধবিগ্রহ। বিভিন্ন নতুন অঞ্চলে আক্রমণ করে, ধন-সম্পদ লুট করে রাজারা নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করতেন। পরাজিত এলাকা থেকে সাধারণ মানুষদের বন্দি করে নিয়ে এসে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিতেন। নিজেদের সেবায় নিয়োজিত করতেন। অন্যদিকে রাজা ও পুরোহিতেরা সাধারণ মানুষের জন্য রচনা করতেন এমনকিছু আইন যার ফলে রাজা ও রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আনুগত্য বৃদ্ধি পেত। নিয়মিত কর-খাজনা দিয়ে, রাজার আদেশ মেনে চলতে বাধ্য হতো।
প্রাচীন মিশরের রাজা (ফারাও): নিজেদের দাবি করতেন তারা দেবতার বংশধর
কৃষির উপর ভিত্তি করে প্রাচীন মিশরে যখন নগর গড়ে ওঠে তখনই সেখানে রাজা এবং রাজতন্ত্রের সূচনা হয়। মিশরীয় রাজাদের উপাধি ছিল ফারাও বা ফেরাউন। ফারাও শব্দের অর্থ হচ্ছে, সুবৃহৎ বাড়ি। মিশরের রাজাগণ সুবিশাল প্রাসাদে বসবাস করতেন বলেই হয়তো তাদের এই নাম দেওয়া হয়। আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে মিশরে রাজতন্ত্রের সূচনা হয় এবং একে একে অনেকগুলো রাজবংশের উত্থান ঘটে সেখানে। মিশরের বিখ্যাত ফারাওদের মধ্যে মেনেস, কুফু, আমেন হোটেপ এবং তুতেনখামেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নেফারতিতির সমাধি-মন্দিরের দেয়ালে আঁকা চিত্রে দেখানো হয়েছে, তিনি বসে 'সেনেট' নামের একটা খেলা খেলছেন। অনুমান করা হয়, খেলাটা বর্তমান দাবা খেলার মতন কোনো খেলা ছিল।
দেয়ালে আঁকা মিশরের চাষাবাদের ছবি
মিশরের ফারাওগণ ছিলেন বিপুল সম্পদ ও সামরিক ক্ষমতার অধিকারী। নিজেদের তারা সূর্যদেবতা 'রে'- এর পুত্র বলে মনে করতেন। ফারাওগণ ছিলেন রাজ্যের সকল সম্পদ এবং সকল মানুষের প্রাণের মালিক। ফারাওদের ক্ষমতাকে সুসংহত করতে রাজ্যের পুরোহিত বা ধর্মগুরুরাও বিশেষ ভূমিকা রাখতেন। ধর্মীয় নেতারা ফারাওদের সম্পর্কে ভালো ভালো কথা প্রচার করতেন। ফারাওগণ শুধু এই জন্মে নয়, মৃত্যুর পরেও মিশরের মানুষদের রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে প্রচারণা চালাতেন। ধর্মগুরুদের প্রচারণার ফলে ফারাওগণ এতই পবিত্র হয়ে ওঠেন যে, সাধারণ মানুষ তাদের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করত না। মৃত্যুর পর তাদের দেহ যেন অক্ষত থাকে এবং পরকালে আবারও শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন সেজন্যই মূলত তাদের দেহ মমি করে বিশালাকার পিরামিডের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হতো। মৃতদেহের সঙ্গে মূল্যবান পাথর, স্বর্ণ-রৌপ্য দিয়ে দেওয়া হতো। ফারাওগণ তাদের চারপাশে সুবিশাল সৈন্যদল, উচ্চপদস্থ অমাত্য এবং ধর্মগুরুদের রাখতেন। এরা ছিল সবাই সুবিধাভোগী উচ্চশ্রেণির মানুষ।
স্পার্টা: একটি বর্বর ও পশ্চাৎপদ সামরিক রাষ্ট্র
প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার নাম আমরা সকলেই শুনেছি। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল অনেকগুলো ছোটো ছোটো নগররাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে। নগররাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এথেন্স ও স্পার্টার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ৭৫০ থেকে ৫৫০ প্রাক্ সাধারণ অব্দের মধ্যে এই নগররাষ্ট্রগুলোর বিকাশ ঘটে। স্পার্টা ছিল একটি সামরিক রাষ্ট্র। স্পার্টার রাজা ছিলেন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তিনিই ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রের প্রজারা তাঁর আদেশকে আইন হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য ছিল। স্পার্টা ছিল একটি যুদ্ধবাজ রাজার নগরী। এখানে নতুন শিশুর জন্ম হলে প্রথমেই শিশুটিকে একটি সংস্থায় নিয়ে যাওয়া হতো। শিশুটিকে যদি সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান দেখাত তবে তার লালন-পালনের অনুমতি দেওয়া হতো। আর যদি দুর্বল ও অসুস্থ মনে হতো তবে তাকে পাহাড়ের উপর থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করা হতো।
স্পার্টার রাজা ও অভিজাত শ্রেণির মানুষেরা একজন শিশু বড়ো হয়ে যোদ্ধা হতে পারবে কি না, তা পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে দেখে তবেই তাকে বাঁচিয়ে রাখার অনুমতি দিতেন। মাত্র সাত বছর বয়সেই এসব শিশুকে তাদের পরিবার থেকে কেড়ে নিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণে লাগিয়ে দিতেন। খাড়াই পর্বতে, তীব্র শীত ও গরমের মধ্যে সামান্য একখণ্ড বস্ত্র আর অল্প একটু খাদ্য দিয়ে শিশুদের কঠোর ও নির্দয় একটি জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া হতো। এরপর এরা বড়ো হলে সৈন্যদলে নেওয়া হতো। বিভিন্ন রাজ্যে আক্রমণ, লুণ্ঠন ও হত্যার কাজে লিপ্ত করা হতো। আর এর মাধ্যমে যে সম্পদ অর্জিত হতো, তা দিয়ে স্পার্টার রাজা ও অভিজাত শ্রেণির মানুষেরা বিলাসী জীবনযাপন করতেন। গ্রিসের অন্যান্য নগররাষ্ট্রগুলোর তুলনায় স্পার্টার মানুষের জীবন ছিল নীরস ও কঠোর। মাত্রাতিরিক্ত রক্তপাত ও যুদ্ধবিগ্রহের কারণে শিল্প, সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চায় তাঁরা ছিলেন খুবই পশ্চাৎপদ। সভ্যতার ইতিহাসে, মানুষের কল্যাণে, জ্ঞান ও শিল্পের উন্নয়নে তাঁরা তাই সামান্যতম অবদানও রাখতে পারেননি।
এথেন্স: প্রাচীন পৃথিবীতে প্রথম যারা গণতন্ত্র বা মানুষের অংশগ্রহণমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল
প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার স্পার্টা সমসাময়িক একটি নগররাষ্ট্রের নাম হচ্ছে এথেন্স। শুরুর দিকে এথেন্সেও একজন রাজার শাসন এবং বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র চালু ছিল। সমাজে চার শ্রেণির মানুষ ছিল। এর মধ্যে শুধু ধনী অভিজাতরাই রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করত। সাধারণ কৃষক, বণিক, কারিগর ও দাসরা ছিল রাজনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
সাধারণ পূর্বাব্দ সপ্তম শতকে এথেন্সের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। অভিজাত শাসক ও যোদ্ধাদের অতিরিক্ত ভোগ-বিলাস এবং সম্পদ সঞ্চয়ের ফলে সাধারণ কৃষক ও শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সকল ভূমির মালিকানা চলে যায় অভিজাত শ্রেণির হাতে। এর ফলে ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক ও ঋণগ্রস্ত শ্রমিকেরা অভিজাত শ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ভূমির উপর মালিকানা, ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের দাবিতে এই আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। মানুষের এই দাবির মুখে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংস্কার সাধনে বাধ্য হন সেখানকার শাসকেরা। সোলন, ক্লিসথিনিস, পেরিক্লিস নামের শাসকেরা এমন কিছু নিয়ম-নীতি নিয়ে আসেন যার ফলে শাসক ও অভিজাত শ্রেণির মানুষদের একচেটিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা খর্ব হতে থাকে আর মানুষের অধিকার বৃদ্ধি পেতে থাকে।
জমির উপর কৃষকদের মালিকানা, ঋণের দায়ে সাধারণ প্রজাদের ক্রীতদাসে পরিণত না করার আইন হয় এথেন্সে। এরপর সাধারণ কৃষক, বণিক ও কারিগর শ্রেণির মানুষদের নিয়ে একটি অ্যাসেমব্লি গঠন করা হয়। ১০ দিন পরপর এই অ্যাসেমব্লির অধিবেশন বসত। অধিবেশনে যেকোনো নাগরিক রাষ্ট্রের আইন, প্রশাসন, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি-সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে প্রস্তাব পেশ করতে পারত। গণপরিষদ ছাড়াও গোপন ভোটে নির্বাচিত ৫০০ সদস্যের একটি পরিষদ ছিল, যারা আইন ও বিচারকার্য ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, তা তদারকি করতেন। এছাড়া ১০ জন সেনানায়কের একটি পরিষদ ছিল। এই পরিষদ প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হলেও তা গণপরিষদের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিল।
প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সেই প্রথম রাজ্য পরিচালনা এবং আইন প্রণয়ন-সংক্রান্ত কাজে সাধারণ নাগরিকদের অংশগ্রহণ শুরু হয়। যদিও এথেন্সের বিপুলসংখ্যক দাস এবং নারীরা এই অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল, তবুও এথেন্সকে বলা হয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার বা আঁতুড়ঘর। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে এথেন্সে যে শাসনব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়, বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে তারই পরিণত ফল হিসেবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
সে সময়ের অন্যতম প্রধান নগররাষ্ট্র এথেন্সের নগরের মূল কেন্দ্র বা অ্যাক্রোপলিসেরে বর্তমান আলোকচিত্র (Source: history4kids.co)
অনুশীলনী প্রাচীন মিশর, স্পার্টা ও এথেন্সের রাজনৈতিক সংগঠন, সমাজ ব্যবস্থা এবং সাধারণ মানুষের অবস্থা সম্পর্কে আমরা জেনেছি। উপরের পাঠের আলোকে এই তিনটি স্থানের মানুষের রাজনৈতিক জীবনধারার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে নিচের ছকটি পূরণ করি- |
মিশর | স্পার্টা | এথেন্স |
| ||
| ||
| ||
| ||
|
সাম্রাজ্যবাদের যুগ
বাংলা অঞ্চল রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, প্রাচীন নগর সভ্যতা এবং জনপদভিত্তিক রাজনৈতিক ইউনিটগুলোর মধ্য থেকেই একসময় একেকটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে। এরপর যুদ্ধ ও রক্তপাতের মাধ্যমে চারদিকে দখল অভিযান চালিয়ে বিশাল সাম্রাজ্যে রূপদান করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মৌর্য, গুপ্ত এবং বাংলার পাল বংশ এরূপ বংশানুক্রমিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অন্যতম উদাহরণ। বাংলা এবং দক্ষিণ এশিয়ার মতো বিশ্বের অন্য অনেক অঞ্চলে ঠিক একই সময়ে অনেকগুলো ক্ষমতালোভী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্থান ঘটে। এরা পৃথিবীর বিস্তৃত অংশ জুড়ে হত্যা, লুণ্ঠন ও দখল অভিযান পরিচালনা করে নিজেদের রাজ্য সীমানা বৃদ্ধি করে। এসব শক্তির উত্থান পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাস ও মানুষের রাজনৈতিক পরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গভীর প্রভাব বিস্তার করে। পৃথিবীর ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদী শাসক হিসেবে যাদের নাম সবার আগে নিতে হয়, তার মধ্যে ম্যাসিডোনিয়ার আলেকজান্ডার, রোমান সাম্রাজ্যের জুলিয়াস সিজার, ফ্রাঙ্ক সম্রাট শার্লামেন, মঙ্গোলীয় যোদ্ধা চেঙ্গিস খান, গজনভী বংশের শাসক সুলতান মাহমুদ, ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, জার্মানির হিটলার এবং ইটালির বেনিতো মুসোলিনির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সাধারণ পূর্বাব্দ পঞ্চম শতকের শুরুর দিকে স্পার্টান যোদ্ধারা এথেন্সের উপর দখল প্রতিষ্ঠার জন্য একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করে। স্পার্টা ছিল একটি সামরিক রাষ্ট্র। এথেন্সের গৌরব নষ্ট করা এবং সম্পদ দখলের লোভেই মূলত এই আক্রমণ পরিচালিত করে। এই যুদ্ধে একসময় গ্রিসের সবগুলো নগররাষ্ট্রই জড়িয়ে পড়ে। সমগ্র গ্রিস স্পার্টা এবং এথেন্স- এই দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই যুদ্ধ সুদীর্ঘ ৩০ বছর ব্যাপী স্থায়ী হয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধ পেনোপনেশীয় যুদ্ধ নামে পরিচিত। ত্রিশ বছর ধরে চলমান এই যুদ্ধের ফলে এথেন্সের সুসজ্জিত ঘরবাড়ি, বাগান, শস্যক্ষেত্র সবকিছু পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। খাদ্যের অভাব ও মহামারিতে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি হয়ে অনেকেই স্পার্টার দাসে পরিণত হয়। দীর্ঘ এই যুদ্ধের সময়ে গ্রিসের শক্তিশালী নগরগুলো যখন দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই গ্রিসের উত্তর দিকে অবস্থিত ম্যাসিডোন নামে একটি রাষ্ট্র শক্তি সঞ্চয় করে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসতে শুরু করে। ম্যাসিডোনের শাসক দ্বিতীয় ফিলিপ্পো একটি শক্তিশালী পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্যদল গঠন করে গ্রিসের দুর্বল নগরগুলো দখল করে নিতে শুরু করেন। এভাবে সমগ্র গ্রিসের উপর দখল প্রতিষ্ঠার পর ফিলিপ্পো পারস্য আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। পারস্যের উর্বর ভূমি, মূল্যবান ধন- সম্পদ এবং দাস-দাসীদের উপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্যই মূলত ফিলিপ্পো পারস্য অভিযানের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু এই অভিযান শুরু হবার আগেই ফিলিপ্পো মারা যান। সিংহাসনে আরোহণ করেন তাঁর বিশ বছরের পুত্র আলেকজান্ডার। ইতিহাসের অনেক বইপত্রে যাকে 'আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট' বলেও অভিহিত করা হয়।
পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি অতিকায় সৈন্যদল নিয়ে প্রথমেই এশিয়ার মাইনর অঞ্চলে আক্রমণ চালান। এরপর পারসিকদের পরাজিত করে ভূমধ্যসাগরের তীর ধরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। আলেকজান্ডারের নিষ্ঠুরতা ও কঠোরতা সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার এক নির্মম দলিল হয়ে রয়েছে। তাঁর সমর অভিযানের মুখে যারাই বাধা দিতে চেয়েছে, তিনি তাদের হয় হত্যা করেছেন, নয়তো বন্দি করে দাসে পরিণত করেছেন। তির নামক একটি শহর দখল করার পর আলেকজান্ডারের নির্দেশে ৮ হাজার লোককে হত্যা করা হয়, ৩০ হাজার লোককে বন্দি করে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আলেকজান্ডারের আক্রমণের মুখে পড়ে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, অসংখ্য ঘরবাড়ি, নগর ও শস্যক্ষেত্র বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। মিশর, মেসোপটেমিয়া, মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে প্রাচীন ভারতবর্ষে পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত আলেকজান্ডারের দখল অভিযান বিস্তৃত হয়। তিন বছরের লাগাতার যুদ্ধে এশিয়ার বিস্তৃত এক অঞ্চলজুড়ে তিনি ত্রাসের সঞ্চার করেন।
৩২৩ সাধারণ পূর্বাব্দে তিনি সামান্য জ্বরে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আলেকজান্ডার তখন তাঁর সকল সৈন্য ও সেনাপতিদের নিয়ে ব্যাবিলনে অবস্থান করছিলেন। মৃত্যুর পর আলেকজান্ডারের দেহ সমাধিস্থ করার পূর্বেই তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে রাজ্যের মালিকানা নিয়ে লড়াই শুরু হয়ে যায়। দখলদার শাসকদের দখলকার্যকে মহানভাবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু মানুষের রক্ত ও লাশের উপর দিয়ে যে গৌরব তারা প্রচার করতে চায়, তা আদৌ গৌরব, নাকি লজ্জার তা আমাদের নতুন করে অবশ্যই ভাবতে হবে। মিথ্যা ও অযৌক্তিক গৌরব প্রচারের চেষ্টা ইতিহাসকে বিকৃত করে। সত্য থেকে সবাইকে বঞ্চিত করে।
জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশজাতিরাষ্ট্র বলতে মূলত একক জাতিগত পরিচয় বা জাতীয় আদর্শকে ভিত্তি করে গঠিত রাষ্ট্রকে বোঝায়। সাধারণত জাতিরাষ্ট্রগুলোয় জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মননশীলতার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। নিজস্ব জাতিগত তত্ত্ব ও মূল্যবোধকে এগিয়ে নিয়ে জাতিরাষ্ট্রগুলো বিশ্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্নসের মতে, জাতিরাষ্ট্রের ধারণা ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর ফলে বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে স্বতন্ত্র জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। মূলত 'এক জাতি, এক রাষ্ট্র'- এর ভিত্তিতেই স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়। তবে আধুনিক যুগে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা খুব প্রসঙ্গিক নয়। কারণ, বর্তমানকালে বেশির ভাগ দেশেই একাধিক ভাষা-জাতি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে রাষ্ট্র গঠিত হচ্ছে। যেমন: ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
জাতিরাষ্ট্র বলতে মূলত একক জাতিগত পরিচয় বা জাতীয় আদর্শকে ভিত্তি করে গঠিত রাষ্ট্রকে বোঝায়। সাধারণত জাতিরাষ্ট্রগুলোয় জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মননশীলতার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। নিজস্ব জাতিগত তত্ত্ব ও মূল্যবোধকে এগিয়ে নিয়ে জাতিরাষ্ট্রগুলো বিশ্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্নসের মতে, জাতিরাষ্ট্রের ধারণা ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর ফলে বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে স্বতন্ত্র জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। মূলত 'এক জাতি, এক রাষ্ট্র'- এর ভিত্তিতেই স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়। তবে আধুনিক যুগে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা খুব প্রসঙ্গিক নয়। কারণ, বর্তমানকালে বেশির ভাগ দেশেই একাধিক ভাষা-জাতি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে রাষ্ট্র গঠিত হচ্ছে। যেমন: ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ফরাসি বিপ্লব
ইউরোপ এবং পশ্চিমা সভ্যতার রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ফরাসি বিপ্লব। এই বিপ্লব ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে প্রজাতান্ত্রিক আদর্শ ধারণ করে যাত্রা শুরু করে এবং একই সঙ্গে দেশের রোমান ক্যাথলিক চার্চের সকল গোঁড়ামি ত্যাগ করে নিজেদের পুনর্গঠন করতে বাধ্য হয়। ফরাসি বিপ্লব পশ্চিমা রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। যার মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতা নিরঙ্কুশ রাজনীতি এবং অভিজাততন্ত্রের ক্ষমতা ভেঙে নাগরিক অধিকারের রাজনীতিতে প্রবেশ করে। ইতিহাসবিদগণ এই বিপ্লবকে মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করেন।
ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতি ছিল, 'সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা'। এই স্লোগানটিই বিপ্লবের চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছিল যার মাধ্যমে সামরিক এবং অহিংস উভয়বিধ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর উপর ভিত্তি করেই ১৭৮৯ সালের ২৬ আগস্ট মানবিক ও নাগরিক অধিকারের ঘোষণা করা হয়। যার মূল বিষয়বস্তু ছিল, 'সব মানুষই স্বাধীন, সব মানুষেরই সমান অধিকার ভোগ করা উচিত। আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিকই সমান।' রেনেসাঁর মতোই ফরাসি বিপ্লবও আধুনিক ইউরোপের রাজনৈতিক, সামাজিক ও চিন্তার জগতে নতুন ধারার জন্ম দেয়। ফরাসি শাসক চতুর্দশ লুইয়ের শাসনকালে (সাধারণ অব্দ ১৬৫১- ১৭১৫) ফ্রান্স একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চদশ লুই এবং যোড়শ লুই-এর সময়ে ফ্রান্সে আর্থসামাজিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক দুর্বলতা একসঙ্গে হয়ে ফ্রান্সে বিপ্লব পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। যার বিস্ফোরণ ঘটে ১৪ জুলাই, ১৭৮৯ সাধারণ অব্দে বাস্তিল কারাদুর্গ আক্রমণ ও এর পতনের মধ্য দিয়ে। সূচিত হয় বিশ্ব ইতিহাসের নতুন অধ্যায় ফরাসি বিপ্লব। ফরাসি বিপ্লবের এই অবস্থাকে অনেকগুলো ছোটো-বড়ো খরস্রোতা নদীর সংমিশ্রণে হঠাৎ ফুলে-ফেঁপে ওঠা বিধ্বংসী বন্যার সঙ্গে তুলনা করা হয়।
ফরাসি বিপ্লব শুধু ফ্রান্সেই নয়, বলতে গেলে ইউরোপ জুড়েই সুবিধাভোগী অভিজাতদের বিরুদ্ধে, অবাধ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-বিদ্রোহ বিপ্লবে রূপ নিয়েছিল। রাজা ষোড়শ লুই-এর পতনের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের পতন হয়েছিল। একই সঙ্গে বিপ্লবী মনোভাব সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজনীতিতে রাজতন্ত্রের স্থলে গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি, একজন স্বতন্ত্র মানুষ) ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রভৃতি ধারণা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের অধিকার কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, রাজনীতি ও ক্ষমতায় আবির্ভূত হয় সাধারণ মানুষ। ইউরোপজুড়েই তখন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে।
রাজতন্ত্রের পতন এবং মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ফরাসি বিপ্লবের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করে চলো একটি টীকা লিখি। |
ঔপনিবেশিকবাদ, বিশ্বযুদ্ধ এবং মানুষের মুক্তির লড়াই
জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব, ফরাসি বিপ্লব, রেনেসাঁ প্রভৃতি ঘটনার মধ্য দিয়ে ইউরোপের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন ধারার সূচনা হলেও এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকার অনেকগুলো দেশে সেই আলো তো পৌঁছায়ইনি, বরং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কলোনি হিসেবে নির্দয়ভাবে শাসন ও শোষণের শিকার হচ্ছিল। বিশেষ করে আফ্রিকা এবং এশিয়ায়।
এই দখলদারিত্বের পরিণতি ছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের লাভ-ক্ষতি, ক্ষয়-ক্ষতি, জয়-পরাজয়কে কেন্দ্র করে ইউরোপের রাজনীতিতে পরাপস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস দানা বেঁধে ওঠে। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ২০ শতকের প্রথমার্ধেই ইউরোপে বিভিন্ন রকমের রাজনৈতিক মতবাদ গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব, অন্যদিকে রাজনীতিতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের সরকার ব্যবস্থা, বিভিন্ন রকমের রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফলে ইউরোপ জুড়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং একটি যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফলে বিশ্বসভ্যতা ২০ শতকের প্রথমার্ধেই দুটো রক্তক্ষয়ী বিশ্বযুদ্ধ মোকাবিলা করে। এ সময় নিজেদের প্রয়োজনে বা দাস ব্যবসার অংশ হিসেবে উপনিবেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে অভিবাসন ঘটে। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তাদের নিজস্বতা বজায় থাকে। সাধারণ অব্দ ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হলে ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগিজসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বিশেষ করে এশিয়া এবং আফ্রিকায় দখলকৃত ভূখণ্ডগুলো থেকে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং সেখানে নব্য স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। যেমন: দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতবর্ষে ১৯৪৭ সালে স্বাধীন পাকিস্তান ও ভারতের জন্ম। তেমনি আফ্রিকায়ও সুদান, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। তাছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব শান্তি রক্ষার স্বার্থে সব দেশের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
আমরা বর্তমানকালের আরও একটি দেশের কথা সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করব। সেটি হচ্ছে আমেরিকা। তোমরা যদি আমেরিকার দিকে লক্ষ করো, দেখবে- আজকের যে শক্তিশালী-সমৃদ্ধ আমেরিকা, শান্তিপ্রিয় আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন সভ্যতা থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন এবং অপরিচিত ছিল। উন্নত ও আধুনিক সামরিক কৌশলও তাদের জানা ছিল না। আমেরিকায় বহু বছর ধরে যারা বাস করছিল, তাদের বলা হয় আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ান। তারা একেবারেই সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। সাধারণ অব্দ ১৬ শতক পর্যন্ত তীর, ধনুক, বল্লম, বর্শা এসব হাতিয়ারের সঙ্গেই পরিচিত ছিল। ইউরোপ থেকে আগত অনুপ্রবেশকারীদের সহজেই আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের পরাজিত করা সম্ভব হয়েছিল আমেরিকাতেও ইনকা সভ্যতা, মায়া সভ্যতা, আজতেক সভ্যতা প্রভৃতি নামে বিভিন্ন সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের পর আমেরিকায় দখলদারিত্বের প্রথম আঘাত আনে স্পেন। স্থানীয় অধিবাসীদের দমন করে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
একইভাবে ব্রিটিশরাও সাধারণ অব্দ ১৬ থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত আমেরিকায় দখলদারিত্ব ও রাজনৈতিক প্রভাববলয় তৈরি করেছিল। তারা ভার্জিনিয়াসহ একে একে ১৩টি উপনিবেশ স্থাপন করে। বাদ যায়নি ফ্রান্সও। তারাও আমেরিকার পোর্ট রয়্যাল, কানাডার কুউবেকে দুটি ঘাঁটি স্থাপন করে প্রভাববলয় সৃষ্টি করে। এভাবেই আমেরিকাজুড়ে ইউরোপীয় দখলদারিত্ব সৃষ্টি হয়। তবে আমেরিকা দখলের বিষয়টি ছিল মূলত আবিষ্কারের মাধ্যমে। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের পর থেকে আমেরিকার নতুন নতুন ভূখণ্ডে ইউরোপীয়রা আসতে শুরু করে, আবিষ্কার করতে থাকে এবং নিজেদের ক্ষমতা ও দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে। অন্যদিকে এশিয়া আফ্রিকার মতো আমেরিকাতেও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি হয়। জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসনদের মতো দেশপ্রেমীক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। ফলে ১৮ শতকের শেষের দিকে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে আমেরিকা। ৪ জুলাই ১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
তবে ইউরোপীয়রা একে একে আমেরিকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেও ইউরোপের মতো রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না আমেরিকায়। আমেরিকায় স্বাধীনতা প্রাপ্তি থেকেই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত ছিল, এখনো আছে।
আরও দেখুন...